পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব উপলব্ধি করেই ইন্দোনেশিয়ার মাসাকা দ্বীপে বালু উত্তোলন বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রত্যেক নদীতেই দেদারসে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে,মুনাফাখোরদের কাছে অক্সিজেন ও পানির চেয়ে টাকা বেশী দরকারী। সাধারণ চোখেই দেখা যায়, ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর গতিপথের পরিবর্তন, নদীর তলদেশের আকার-আকৃতির ভারসাম্য নষ্ট,পানি প্রবাহের প্রাকৃতিক গতিধারা ব্যাহত হওয়ার চিত্র। নদীর বুকে নির্দিষ্ট একটি স্থানে ড্রেজার দিয়ে খনন করলে গভীরতার তারতম্য সৃষ্টি হয়। সাধারণত নদীর স্রোতধারা কৌনিকভাবে নদীর তীরে আঘাত হানে। দৌলতপুরে বালু উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে,অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস ও মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশবিদদের দাবী,মৎস সম্পদ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। সম্প্রতি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা,তালবাড়ীয়াসহ বিভিন্ন স্থানে পদ্মায় ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। অনুসন্ধানে জানাগেছে,রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চক রাজাপুর,আলাইপুর এলাকা থেকে ড্রেজার দিয়ে একটি প্রভাবশালী চক্র বালু উত্তোলন করছেন। দৌলতপুর উপজেলার চিলমারী,কোলদিয়াড়,মাজদিয়াড় সংলগ্ন ঘাট দিয়ে বালু বোঝাই কার্গো রায়টা নামক স্থানে আসে। এসব ফিটনেসবিহীন কার্গোর গতিজনিত স্রোতে কোলদিয়াড় অংশে ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এসব কার্গোর বালু ধারণ ক্ষমতা আনুমানিক ৪ হাজার বর্গ ফুট। রায়টা আসার জন্য বিকল্প নৌপথ না থাকায় কোলদিয়াড় ঘাট হয়েই যাতায়াত করে এসব কার্গো। এসব কার্গো থেকে প্রতি বর্গফুট বালুর জন্য ২ টাকা হিসেবে ৮/১০ টাকা চাঁদা আদায় করছে সন্ত্রাসী চক্র। চাঁদার ভাগ পৌঁছে দিচ্ছে প্রভাবশালীদের পকেটে। বালু উত্তোলনের পাশাপাশি জলপথে মাদক চোরাচালান ও আইন-শৃংখলার অবনতির পেছনেও রয়েছে এই জলদস্যু চক্র। কিছুদিন পূর্বেও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া দিয়ে পদ্মার বুকে আতংক ছড়িয়েছে তারা। স্থানীয় জনগণ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়না। নদীভাঙ্গনের ফলে রায়টা-মহিষকুন্ডি নদী রক্ষা বাঁধ,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,মসজিদ,বাজার সহ ৪/৫ লাখের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। প্রায় ৭০০ এর উপরে নদী রয়েছে দেশে এবং এদের সম্মিলিত দৈর্ঘ্য হচ্ছে ২৪০০০ কিলোমিটারের বেশি। নদী ভাঙ্গন একই সাথে জাতীয় ও বৈশ্বিক সমস্যা। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় কারণেই বাংলাদেশে নদী ভাঙ্গন দেখা দেয়। উজানে বিভিন্ন স্থাপনার কারণে প্রবাহের গতি যখন শ্লথ হয়, তখন সিল্ট বা তলানিপ্রবাহ সাগরে যাওয়ার আগে মাঝপথেই আটকে যায়৷ ঘন ঘন চর পড়ে, গভীরতা কমতে থাকে৷ এখন তলদেশ যদি উন্নত হতে থাকে, পাড়ে যত বাঁধই দেওয়া হোক না কেন, ওই নদীর পানি জনপদের দিকে ছুটে চলে।
যেমন- যমুনা নদীর প্রস্থ বেশি গভীরতার তুলনায়। যখন পানি উজান থকে সাগরের দিকে যেতে থাকে তখন অতিরিক্ত চাপের ফলে দুই পাড়ের কয়েক মিটার ভেঙে যায়। আবার নদী যখন পানিতে পূর্ণ হয় তখন তীব্র স্রোত দুই পাড়ে ব্যাপক ভাঙন সৃষ্টি করে। পদ্মার তীব্র স্রোতের কারণে এটিকে বলা হয় বিশ্বের তীব্র ভাঙ্গন প্রবণ নদী। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসা এক গবেষণায় জানিয়েছিল, ১৯৬৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ৬৬ হাজার হেক্টরের (প্রায় ২৫৬ বর্গমাইল বা ৬৬০ বর্গকিলোমিটার) বেশি এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় আড়াই গুণের সমান। প্রতিবেদনে পদ্মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ধারা ৫-এর ১ উপধারা অনুযায়ী, পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। আইন অমান্যকারী দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বলা বাহুল্য, এসব আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। বালুদস্যুদের প্রতিহত করতে পারলেই নদী বাঁচবে। দেশ বাঁচবে। ভাঙ্গনের ফলে নদীতীরবর্তী জনপদের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশের ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। এতে প্রায় ১৭ লাখ ১৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
বালুর কণায় থাকে ফাইটোপ্লাঙ্কটন,জুয়োপ্লাঙ্কটনসহ নানা বিধ রাসায়নিক উপাদান। বালু উত্তোলনের ফলে মাটিতে মিশে থাকা অক্সিজেন,ক্যালসিয়াম,নাইট্রোজেন ও ম্যাগনেশিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলে মাছসহ অন্যান্য ক্ষূদ্র ও বৃহৎ প্রাণী খাদ্যসংকটে পড়বে। পদ্মার সাথে জড়িয়ে রয়েছে শত শত শাখা ও উপনদী। বাংলাদেশের সকল নদীর গতিপথ বঙ্গোপসাগর অভিমূখে। ২০২১ সালের মার্চে ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায়ে গঙ্গা ও যমুনা নদীসহ বাস্তুতন্ত্রকে জীবন্ত মানুষের মর্যাদা দিয়েছেন। ফলে মানুষের যেসব আইনি অধিকার রয়েছে, এসব নদীরও তেমনি আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবৈধ বালু উত্তোলনসহ অন্যান্য দূষণ থেকে নদীকে বাঁচাতে এ রায় দেওয়া হয়। বালু উত্তোলনের পূর্বে অবশ্যই বিআইডব্লিটিএ কর্তৃক হাইড্রোফিলিক সমীক্ষা করতে হবে। নগরায়ন ও উন্নয়নের দায় দিয়ে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে নদী হত্যা কখনো কাম্য নয়। দৌলতপুর উপজেলার মানচিত্র রক্ষায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি।