সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার মঞ্চনাম মান্না, জন্ম ১৪ এপ্রিল ১৯৬৪ মৃত্যু ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮চ লচ্চিত্র অভিনেতা ও প্রযোজক। মান্না চব্বিশ বছরের কর্মজীবনে তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত আম্মাজান চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিনি বীর সৈনিক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং আম্মাজান চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসাবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন।
প্রারম্ভিক ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা
মান্না ১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গায় সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নুরুল ইসলাম তালুকদার ও মাতা হাসিনা ইসলাম। মান্না উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে ঢাকা কলেজে স্নাতকে ভর্তি হন।
ব্য সহ-অভিনেত্রী শেলী কাদেরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির সিয়াম ইলতিমাস মান্না নামে এক পুত্র সন্তান রয়েছে।
মান্না ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (এফডিসি) আয়োজিত নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রমে নির্বাচিত হন।১৯৮৫ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত পাগলী চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। যদিও তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র তওবা। এরপর তিনি নিপা মোনালিসার বিপরীতে শিমুল পারুল (১৯৮৫), রেহানা জলির বিপরীতে নিষ্পাপ (১৯৮৬), কবিতার বিপরীতে বাপ বেটা ৪২০ (১৯৮৮), চম্পার বিপরীতে ভাই (১৯৮৮), আমার জান (১৯৮৮), সুনেত্রার বিপরীতে বাদশা ভাই (১৯৮৯), কোবরা (১৯৮৯), চম্পার বিপরীতে গরীবের বন্ধু (১৯৯০), আম্মা (১৯৯০), রানীর বিপরীতে অবুঝ সন্তান (১৯৯০), ছোট বউ (১৯৯০), পালকী (১৯৯০), দুখী মা (১৯৯০) চলচ্চিত্রগুলোতে অভিনয় করেন।
প্রতিষ্ঠা লাভ (১৯৯১-১৯৯৬) সম্পাদনা
মান্না ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত কাসেম মালার প্রেম চলচ্চিত্রে প্রথম একক নায়ক হিসেবে চম্পার বিপরীতে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হলে, তিনি কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করারও সুযোগ পান।
এরপর ১৯৯২ সালে কাজী হায়াতের দাঙ্গা ও ত্রাস চলচ্চিত্রেও একক অভিনেতা হিসাবে সফলতা পান তিনি। একই বছর তার অভিনীত মোস্তফা আনোয়ারের অন্ধ প্রেম, মনতাজুর রহমান আকবরের প্রেম দিওয়ানা ও ডিস্কো ড্যান্সার, কাজী হায়াতের দেশদ্রোহী, মনতাজুর রহমান আকবরের বাবার আদেশ, অশোক ঘোষের শাদী মোবারক, বুলবুল আহমেদের গরম হাওয়া, সাইফুল আজম কাশেমের সাক্ষাৎ, কামাল আহমেদের অবুঝ সন্তান, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর গরীবের বন্ধু চলচ্চিত্রগুলো মুক্তি পায়।
১৯৯৩ সালে তিনি কাজী হায়াতের চাঁদাবাজ, সিপাহী, দেশপ্রেমিক, দেশদ্রোহী, ধর, তেজী ও সমাজ কে বদলে দাও, নুর হোসেন বলাইর ওরা তিনজন ও শেষ খেলা, নাদিম মাহমুদের আন্দোলন, রুটি ও রাজপথের রাজা, এম এ মালেকের দুর্নীতিবাজ, এফ আই মানিক পরিচালিত বিশাল আক্রমন মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর চিরঋণী, এ জে রানা পরিচালিত মানুষ, বেলাল আহমেদ পরিচালিত সাক্ষী প্রমাণ এবং মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ডিস্কো ড্যান্সার ও বশিরা ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলোতে অভিনয় করেন।
মান্না ১৯৯৭ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত লুটতরাজ চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেন, যেখানে তার বিপরীতে অভিনয় করেন মৌসুমী ও দিতি। চলচ্চিত্রটি ব্যবসায়িকভাবে সফলতাও পেয়েছিল।এরপর এনায়েত করিমের ক্ষুধার জ্বালা, নাদিম মাহমুদের এতিমরাজা, কাজী হায়াতের তেজী, মনতাজুর রহমান আকবরের শান্ত কেন মাস্তান, ইস্পাহানি আরিফ জাহানের মোস্তফা ভাই,দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর রাজা বাংলাদেশী ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলো মুক্তি পায়।
১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় কাজী হায়াৎ পরিচালিত আম্মাজান চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যেখান তার সঙ্গে অভিনয় করেন শবনম, আমিন খান ও মৌসুমী। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি প্রথম বাচসাস পুরস্কার ও মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন। একই বছর তিনি রায়হান মুজিব ও আজিজ আহমেদ বাবুল পরিচালিত খবর আছে, মালেক আফসারীর লাল বাদশা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যা তিনি প্রযোজনাও করেছেন।
২০০০ সালে তার প্রযোজিত তৃতীয় চলচ্চিত্র আব্বাজান মুক্তি পায়। এটি দুটি বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করে। একই বছর তিনি মালেক আফসারী পরিচালিত মরণ কামড়, ছটকু আহমেদ পরিচালিত শেষ যুদ্ধ, মনতাজুর রহমান আকবরের গুন্ডা নাম্বার ওয়ান, কুখ্যাত খুনি, আঘাত পাল্টা আঘাত, মাস্তানের উপর মাস্তান ও ভয়ানক সংঘর্ষ, কাজী হায়াতের বর্তমান, এফ আই মানিকের সুলতান, বদিউল আলম খোকনের দানব, এফ আই মানিক পরিচালিত স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ, যা তার প্রযোজিত চতুর্থ চলচ্চিত্রও এবং কাজী হায়াৎ পরিচালিত সমাজকে বদলে দাও চলচ্চিত্রগুলোতে অভিনয় করেন।
২০০৩ সালে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীভিত্তিক বীর সৈনিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এবছর তার অভিনীত জিল্লুর রহমান পরিচালিত ঈমানদার মাস্তান,ইস্পাহানী আরিফ জাহান পরিচালিত নায়ক, কাজী হায়াতের মিনিস্টার ও কষ্ট, মালেক আফসারীর বোমা হামলা, শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ভেজা বিড়াল, এফ আই মানিক পরিচালিত ও তার নিজের প্রযোজিত দুই বধু এক স্বামী, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর অশান্ত আগুন, ইস্পাহানী আরিফ জাহান পরিচালিত ভিলেন, মনতাজুর রহমান আকবরের আরমান ও টপ সম্রাট, শাহাদাত হোসেন লিটন পরিচালিত কঠিন পুরুষ, বদিউল আলম খোকন পরিচালিত রুস্তম, এফ আই মানিকের ভাইয়া, যেখানে তার বিপরীতে অভিনয় করেন ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রচনা ব্যানার্জী, বদিউল আলম খোকনের ধ্বংস, বাবার কসম ও বাস্তব, শাহিন-সুমন পরিচালিত নেতা, মনোয়ার খোকনের সত্যের বিজয়, শরিফ উদ্দিন খান দিপুর বাঁচাও দেশ, আহমেদ নাসিরের মনের সাথে যুদ্ধ ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলো মুক্তি পায়।
মান্না অভিনয়ের পাশাপাশি কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন। তিনি কৃতাঞ্জলী চলচ্চিত্র নামে একটি প্রযোজনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি লুটতারাজ, স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ, দুই বধু এক স্বামী, আমি জেল থেকে বলছি, পিতা মাতার আমানতসহ মোট আটটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন।
সাংগঠনিক নেতৃত্ব সম্পাদনা
তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
মান্না ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
মৃত্যুর কয়েকমাস পর একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর চিকিৎসকদের অবহেলায় তার মৃত্যু হয়েছে, এমন অভিযোগে তার পরিবারের পক্ষ থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালের ছয় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার শ্যালক রেজা কাদের। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি এই মামলার বিচারবিভাগীয় তদন্তে প্রাথমিকভাবে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত ছয় ডাক্তারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তাদের আট সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের আদেশ দেন। ওই বছরের ১৬ মার্চ চিকিৎসকরা আত্মসমর্পণ করলে ৫০ হাজার টাকা বন্ডে স্বাক্ষর করে জামিন লাভ করেন। এরপর ২০০৯ সালের ১৮ অক্টোবর ওই ছয় ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার বিশেষ দায়রা জজ। এরপর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা অভিযোগ গঠনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট করেন।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে সম্পাদনা
মান্নার স্মরণে তার এক অন্ধ ভক্তের কাহিনী নিয়ে মালেক আফসারী পরিচালিত জায়েদ খান ও পরিমনি অভিনীত অন্তর জ্বালা নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। বিএফডিসিতে তার নামে মান্না ডিজিটাল কমপ্লেক্স হিসাবে একটি ভবন নামকরণ করা হয়। এছাড়াও তার স্মৃতি স্মরণে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন নিয়মিত মান্না উৎসব আয়োজন করে থাকে।
এছাড়া তার জন্ম ও মৃত্যু দিবসে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো স্মৃতিচারণমূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে।