সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ সম্বোধন নিয়ে আলোচনা সমালোচনায় মাঝে মধ্যেই সরগরম হয়ে ওঠে বিভিন্ন মাধ্যম। তবে এর ব্যতিক্রম সমাজসেবা অধিদপ্তর বরিশালের জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ।সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে নয় বরং সেবাপ্রত্যাশীদের ‘স্যার’ ডাকতে অভ্যস্ত তিনি।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবস্থিত সমাজসেবা অফিসের এই দপ্তরে যত লোক আসেন প্রতিদিন তাদের সকলকেই ‘স্যার’ সম্বোধন করেন এই সরকারি কর্মকর্তা।একদিন দুইদিন নয় ২০১৮ সাল থেকে সেবাপ্রত্যাশীদের ‘স্যার’ সম্বোধনের চর্চা করে আসছেন তিনি।
সাজ্জাদ পারভেজ বলেন,বিগত পাঁচ বছরের এই চর্চায় সবচেয়ে সুখকর ব্যাপার হলো আমি হয়তো সকলকে একসঙ্গে সহায়তা করতে পারি না।কিন্তু স্যার সম্বোধন করায় কেউ মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে যান না।তারা সকলেই আশ্বস্ত হন এবং আমার ওপরে ভরসা রাখেন।
সেবাপ্রত্যাশীদের ‘স্যার’সম্বোধন করার চর্চাটি তিনি অবশ্য শুরু করেন সমাজসবো অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালকের অনুপ্রেররণায়।
সাজ্জাদ পারভেজ বলেন,মহাপরিচালক স্যার বরিশাল পরিদর্শনে এসেছিলেন।বিভিন্ন বিষয়ে আলাপের মধ্যেই তিনি অনুরোধ করে বললেন,দপ্তরে যে অসহায় মানুষ গুলো সেবা নিতে আসে তাদের সকলকে হয়তো আপনি সহায়তা করতে পারবেন না।কিন্তু যাকে সেবা দিতে পারছেন না তাকে সম্মানের সঙ্গে স্যার সম্বোধন করলে তিনি আশ্বস্ত হবেন এবং কষ্ট পাবেন না।এতে গরিব মানুষটি শুধু নয়,আপনিও সম্মানিত হবেন। স্যারের কথার অনুপ্রেরণায় পরদিন থেকেই সেবা নিতে আসা মানুষদের স্যার সম্বোধন করে তাদের কথা শুনি।তাতে দেখলাম,সত্যিকার অর্থেই মানুষ গুলো খুশি হচ্ছেন এবং আমার দপ্তরের ওপর ইতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন।
এই কর্মকর্তা বলেন,আমাদের জনবহুল দেশে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। যা সরকারি দপ্তর চাইলেও একসঙ্গে সকলকে সহায়তা করতে পারে না।এতে কিছু কিছু সেবাপ্রত্যাশীরা সংক্ষুব্ধ হন,কষ্ট পান।কিন্তু যখন তাদের স্যার সম্বোধন করা হয় তখন এসব আক্ষেপ আর থাকে না। প্রয়োজনে সেবাপ্রত্যাশী সেবা পেতে ধৈর্য ধরেন।এমনকি আমার দপ্তরে আমার নেমপ্লেটের পরিবর্তে টেবিলে ‘স্যার আপনার জন্য কি করতে পারি?’ লিখে রেখেছি।
গৌরনদীর এক কলেজ শিক্ষক ডা. শাহনাজ ইসলাম রূবি বলেন, ক্যান্সার আক্রান্ত একটি শিশুর সাহায্যের জন্য প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম।সেখানে তার টেবিলে প্রিন্ট করে লেখা ‘স্যার আপনার জন্য কি করতে পারি?’। এমন চিত্র সচরাচর অন্য যেকোনো সরকারি কর্মকর্তার কার্যালয়ে দেখা যায় না।তাছাড়া তিনি সকলকে স্যার বলে সম্বোধন করেন।
এই সেবাপ্রত্যাশী বলেন, সচরাচর সরকারি কর্মকর্তার কাছে গেলে আমাদের স্যার বলতে হয়। কিন্তু এই দপ্তরটিতে তার উল্টো চিত্র।আমার কাছে মনে হয়েছে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক সরকারি কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ।
আমিনুল ইসলাম নামে আরেক সেবাগ্রহীতা বলেন, আমার বাবার চিকিৎসার জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ে সহায়তার আবেদন করেছিলাম।তার কিছু কাজের জন্য সাজ্জাদ পারভেজের কক্ষে গেলে তাকে স্যার ডাকবো কোথায়, তিনিই আমাদের স্যার ডাকছেন দেখে অবাক হয়েছি।বরিশালের কোনো সরকারি কার্যালয়ে এই চর্চা নেই।তার আচরণে আমার অসুস্থ বাবা এত বেশি খুশি হয়েছেন যে প্রায়ই তার প্রশংসা ও গল্প করেন।
করোনারকালে দোকান বন্ধ থাকায় মেয়ের জন্য দুধ কিনতে না পেরে রিকশা নিয়ে নেমেছিলেন আর্টিস্ট মাহাবুব আলম। তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পরপরই নিজের গাড়িতে করে চাল, দুধ ও নগদ টাকা নিয়ে কাউনিয়া মাহাবুবের ভাড়া বাসায় ছুটে যান সাজ্জাদ পারভেজ।
মাহাবুব আলম বলেন, তিনি তার মোটরসাইকেল থেকে চালের বস্তা নিচে নামাচ্ছিলেন।তখনো আমি বুঝিনি তিনি (সাজ্জাদ পারভেজ) বড় সরকারি কর্মকর্তা।শুধু সেটাই নয় তিনি আমার নাম পরিচয় জানতে চাওয়ার সময় স্যার সম্বোধন করেন।এতে আমি আরও অবাক হয়ে যাই।এরপরে যখন জানতে পারি আমার প্রয়োজনে আমার বাসায় চাল নিয়ে এসেছেন এমনকি আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করছেন তখন থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে খারাপ ধারণা ছিল তা বদলে গেছে। আমি ও আমার পরিবার তাকে শুধু শ্রদ্ধাই নয়,তার জন্য সব সময় দোয়া করি।
প্রসঙ্গত, সাজ্জাদ পারভেজ ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে টানা তিনবার জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রবেশন কর্মকর্তা নির্বাচিত হন। জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পান ২০১৯-২০ সালে এবং বরিশাল জেলা প্রশাসন পদক পান ২০১৭ সালে।